মার্চের শেষ দিকে মহামারি করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশজুড়ে অঘোষিত লকডাউন জারি করা হয়। এতে একে একে আলো নিভে যায় দেশের অফিস আদালত থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি মন্দির-মসজিদেরও।
ক্লাস-টিউশনি-কোচিং নিয়ে ইটকংক্রিটের যান্ত্রিক এই শহরে হাঁপিয়ে ওঠাদের একজন হয়ে অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে বেশ আনন্দই লাগছিল, তখন বারবার মনে হয়েছিল, যাক করোনার করুণায় কয়েকটা দিন বাড়ি থেকে দিব্যি ঘুরে আসা যাবে। আহা কতদিন যাওয়া হয়না শৈশবের সেই আখড়াঘরে! চিরচেনা সেই পথ-ঘাট আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর কয়দিন পর তো সব ঠিক হয়েই যাবে। তখন আবার সব হবে। জয় করোনার জয়! প্রথম দফার ছুটি পেরিয়ে দ্বিতীয় দফা গেল, তারপর তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম আরও আরও….তবুও পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হয় না। দিনকে দিন আরও অবনতি ঘটতে থাকে। চারদিকে মন খারাপের সব খবর বাতাসে বেড়ায়। ছেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে করোনার ভয়ে জঙ্গলে ফেলে রাখে, সন্তানরা মৃত মাকে ফেলে দৌড়ে পালায়। হায়রে জীবন! আহা জীবন! বাবা অভিমান করে ওপারে পাড়ি জমানোর পর মা আর ছোট দুই ভাই-বোনকে দেখভালের দায়িত্ব আমার গাড়েই এসে জুটে। তাই পড়াশুনার পাশাপাশি সেই প্রথম বর্ষ থেকেই উপার্জনে সমান মন দিতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সকাল আটটা থেকে কোনদিন নয়টা-দশটা থেকে একটানা দুপুর দুইটা পর্যন্ত ক্লাসের পাঠ চুকিয়েই ছুটতে হতো ফার্মগেটে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি বা একাডেমিক কোন কোচিংয়ে ক্লাস নিতে, তারপর দুইটা টিউশনি শেষ করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হলে ফিরতাম রাত ন’টার একটু পরে। এই ছিলো রোজকার রুটিন এবং নিজে বেঁচেবর্তে থাকার ও তিনটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার সগ্রামের গল্প। কিন্তু হঠাৎ করোনা নামক এক অদৃশ্য শত্রু’র প্রাণঘাতী থাবায় সব ভেস্তে গেল। দেখতে দেখতে বন্ধ হয়ে গেল গােটা কোচিং সেন্টারই, টিউশনি থেকে জানিয়ে দেওয়া হল আর না যেতে। তিলে তিলে গড়া সব হারিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। যার কোন কুল-কিনারা নাই। এ শহরে একটা কাজ ভাগানো যে কত কঠিন, যারা সংগ্রাম করে কেবল তারাই জানে। অথচ কিনা উড়ে এসে জুড়ে বসা সর্বনাশা করোনা শেষপর্যন্ত সব কেড়ে নিল। তবে হতাশ হইনি। এর আগেও যখন বলা নাই কওয়া নাই, সবার সাথে খেয়ে রাতে ঘুমােতে যাওয়া আমাদের সুস্থ বাবা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন, সেসময়ও গভীর সংকটে পড়েছিলাম, কিন্তু কখনও মনোবল হারাইনি। সবসময় ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করেছি, চারপাশে যা ঘটছে তাকে অবদারিত নিয়তি বলে মনকে বারবার আশ্বস্ত করেছি। আর সুযোগ খুঁজেছি কিছু করার। কথায় আছে, ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষেই থাকে। করোনার কারণে আর দশটা মানুষের যখন চাকরিবাকরি হারিয়ে পথে বসার জোগাড়, সেইসময়েও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার কড়া নাড়ে মনের বারান্দায়। সুযােগ এসে লুটিপুটি খেলে দরজার ওপাশে। চাদপুর ইলিশের শহর কে না। জানে! সেই ইলিশকে নিয়েই বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় পেজ খুলে সাড়াও।
পেলাম বেশ। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রোজ দেদারসে ইলিশ বিক্রি শুরু করলাম। যদিও প্রথমদিকে অনেকে বলেছিল, ঢাবিতে পড়ে শেষমেশ কিনা মাছওয়ালা! আমি তবুও দমে। যাইনি। একমুহুর্তের জন্যও হাল ছাড়িনি। কারণ আমি জানি, যুদ্ধ জয়ের লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। ব্যবসায় লাভের মুখ দেখায় এরপর এক বন্ধুর সাথে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিক্রিও। শুরু করলাম। এখানেও আশানুরূপ সাড়া পেলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এখনও, তবে আগের মতো অনেক কিছুই একে একে খুলে দেওয়া হয়েছে। গ্রাম ছেড়ে আবারও শহরে আস্তানা গেড়েছি। এখন বারবার মনে হচ্ছে লকডাউনের দিনগুলােতে নিজের ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে পরিস্তিতি বুঝে ভিন্ন কিছু করার সাহস পেয়েছি কেবল ইতিবাচক থাকার কারণেই।
(মোরাল অব দ্যা স্টোরি-ইতিবাচক থাকতে হতাশ না হয়ে যেকোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে সর্বক্ষণ, সফলতা আসবেই। কথায় আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা, আসলে আমি বলি, অলস মস্তিষ্ক নেতিবাচক চিন্তার কারখানা। তাই সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে)।
Md. Fokhrul Islam
University
GB029