বন্দিত্ব যখন শাপে বর!

 ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার পরে কেউ যদি জিজ্ঞেস করত যে কোন ক্লাসে পড়ি, তাহলে বেশ দোটানায় পড়ে যেতাম

বলা যায় ক্লাস টেন, না বলা যায় কলেজ। মহা মুশকিল। তাই বলতামআপাতত বেওয়ারিশ। এখনকার অবস্থাও অনেকটা সেরকম। এইচএসসি২০২০ ব্যাচ হিসেবে পরীক্ষা ঝুলে পড়ায় আদৌ ২০২০ ব্যাচ থাকবাে নাকি তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। না পারছি পরীক্ষা শেষের মত নিশ্চিন্ত সময় কাটাতে, আবার না পারছি সম্পূর্ণ মনােযােগ দিয়ে পড়ালেখা করতে। পরীক্ষা কবে হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যাওয়ায় এখন পড়ার মুডটাই আসছেনা। যেদিন পরীক্ষা স্থগিতের ঘােষণা আসলাে, তার এক সপ্তাহ আগেও– ‘না জানি কেমন প্রশ্ন হবে, কী যে পরীক্ষা দিবােএরকম নানা চিন্তায় ছিলাম। আর এখন সেই পরীক্ষাকেই যেন পুরনাে বন্ধুর মত মিস করছি! থমকে যাওয়া অনুভূতি হলেও পুরাে সময় অলসও কাটছেনা। পরীক্ষার পরে করবাে বলে যেসব কাজ জমিয়ে রেখেছিলাম তার কিছু করেছি। আর করতে গিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আর নতুন উপলব্ধী হচ্ছে। যেমন, কোয়ারেন্টাইনের প্রথম কিছুদিনে নিজের পুরাে ঘর একটু একটু করে গুছিয়েছি। বইয়ের সেলফ গােছাতে গিয়ে বেশ কয়েকটা না পড়া বই বের হলাে। একটা ইংরেজি, একটা বাংলা এভাবে করে বইগুলাে পড়ার জন্য একটা তালিকা করলাম। বইগুলাে পড়ে নিজের মনে আসা উপলব্ধীগুলাে ডাইরীতে লিখে রাখলাম, যা বহুবার করবাে করবাে করেও কখনাে শুরুই করা হয়নি। পড়ালেখার পাশাপাশি আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছি। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কিছু তথ্য মাঝে মাঝে প্রয়ােজন হয়। এই ফাঁকা সময়ে সেই বিষয়ে কিছু পড়াশােনা এগিয়ে রাখার জন্য রবীন্দ্র রচনাবলী পড়া শেষ করে ফেলার চেষ্টা করবাে বলেও ঠিক করেছিলাম কোয়ারেন্টাইনের প্রথমে। সেই লক্ষ্য ধরেও আগাচ্ছি। দ্বিতীয়দিন কেবিনেটের তাকে আঁকাআঁকি আর ক্রাফটিং এর জিনিসগুলাে গােছালাম। পুরনাে কিছু স্কেচ, পেইন্টিং খুঁটিয়ে দেখে নিজেই সমালােচনা করলাম। কিছু হাবিজাবি পুরােনাে লেখালেখি পড়ে একাই হাসলাম। নিজের করা পুরনাে ভুলগুলাে শুধরে নেয়ার সুযােগ হিসেবে এখন সময়টা কাজে লাগাচ্ছি। স্কুল লাইফে বন্ধুদের কাছ থেকে জন্মদিনে পাওয়া বেশ কিছু হাতে বানানাে উপহার, কার্ড বের হলাে। সেগুলাে দেখে এই ক্ষুদ্র জীবনে কাটানাে সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলাের কথা মনে পড়ে গেলাে। এই উপহারগুলাের আর্থিক মূল্য হয়তাে কমই কিন্তু এগুলােই আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। এইটা তাে গেলাে কেবল ঘর গােছানাের অধ্যায়। পরের কিছুদিন রান্নাঘরকে বানিয়ে ফেলেছিলাম আমার গবেষণার ল্যাবরেটরি। ভবিষ্যতে কোন এক সময় শেফট্রেনিং নেয়ার পরিকল্পনার হাতেখড়ি কিছুটা সময়ে এগিয়ে রাখলাম। একেকদিন একেক খাবার বানালাম আর বাসার সবার রিভিউ নিলাম। অঘটনও ঘটেছে কিছু। প্রথমদিন পিজ্জা বানাতে গিয়ে ডাে হয়েছিলাে রাবারের মতাে! তবে ভালাে অভিজ্ঞতাও আছে। এক প্রতিবেশী জুনিয়রের জন্মদিনের কেক বানাতে গিয়ে হয়ে গেছে কেক ডেকোরেশন শেখার শুরুটা। তবে এতাে অঘটনের পরও বড় সাফল্য হল এখন বিকেলের নাস্তার দায়িত্ব মা। আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আর এর মধ্যে মা জন্মদিন ছিল, সেদিন কেক আর বাহির থেকে কেনার প্রয়ােজন হয়নি, নিজেই বানিয়ে ফেলেছি। সবচেয়ে বড় যে উপলব্ধীটা এসেছে সেটা ঘরের কাজ করতে গিয়ে। আমাদের ঘরের কাজে সাহায্যকারীকে সতর্কতার কথা চিন্তা করে সাময়িক ছুটি দেয়া হয়েছিল। প্রতিদিনই উনার করে দেওয়া কাজগুলাের পেছনে শ্রম কতটা সেটা আগের চেয়ে ভালাে বুঝতে পেরেছি এই সময়ে। তাদের কাজ নিয়ে হয়তাে আমাদের অনেক অভিযােগই থাকে মাঝেমাঝে। কিন্তু, তাদের কাজটাও সহজ না। আমরা যদি শুধু শখ করে খাওয়ার জন্যও এক কাপ চা বানিয়ে দিতে বলি, তখন মনে হয় আর তেমন কী? কিন্তু নিজে করতে গেলে বােঝা যায় যে, চা বানানাে থেকে শুরু করে ব্যবহৃত পাত্রগুলাে ধুয়ে রাখা পর্যন্ত কাজগুলাে উনাদের করতে হয়, যা তখন আর নিজের কাছে সামান্য মনে হবেনা। আর যেটা করছি সেটা হলাে বেশ কিছু অনলাইন প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করছি এবং একটি লেখালেখি প্রতিযােগিতায় সৌভাগ্যবশত পুরস্কারও পেয়েছি। আগে যেকোন আর্ট অথবা ফটোগ্রাফি প্রতিযােগিতার প্রদর্শনীগুলাে হত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে। কলেজ, কোচিং এর ফাঁকে সেগুলােতে সশরীরে হয়ত উপস্থিত থাকতে পারতাম না। এখন প্রদর্শনীও অনলাইনে হওয়ায় সেগুলাে দেখার সুযােগ পাচ্ছি। অন্যান্যদের প্রতিভা দেখে নিজের দুর্বলতাগুলাে উপলব্ধী করে নতুন কিছু শিখছি

সবশেষে কোয়ারেন্টাইনের সবচেয়ে বড় অর্জনের গল্পটা বলি। কোয়ারেন্টাইনে মামা এবং আমার সবচেয়ে ছােট খালাতাে ভাই রেয়ানের সাহায্য নিয়ে শিখেছি সাইকেল চালানাে। প্রচন্ড আগ্রহের একটা স্কিল হলেও এতােদিন বিভিন্ন কারণে যা শেখা হয়নি। শেষ পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনের মত স্থবির একটা সময় শিখতে পারলাম, তাই এই শেখাটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর সেজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ মামা আর খালাতাে ভাই রেয়ানকে। আর এই স্থবির সময়ে সাইকেল চালানাে শিখতে গিয়ে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বলা বিখ্যাত উক্তি– ‘Life is like riding a bicycle to keep your balance you must keep moving’- এর অর্থ আরও গভীর ভাবে বুঝতে পারলাম। যাই হােক, হিসাব করে শুধু খুব বেশি প্রােডাকটিভ কাজ না করলেও এমন ছােট ছােট কাজের মধ্য দিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতাউপলব্ধীর মধ্য দিয়েই যাচ্ছে সময়। সােলসের গানের ভাষায়তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে

সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই কামনা, পরিচিতঅপরিচিত সবাইকে তিনি যেন সুস্থ রাখেন, ভালাে রাখেন করােনার এই কঠিন সময়ে মন খারাপ, বিষণ্ণতা চেপে ধরতে চাইলেও ভালাে দিকটাই টেনে বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এই কঠিন সময় হয়তাে চলে যাবে, কিন্তু এই অভিজ্ঞতাউপলব্ধীগুলাে রেখে যাবে সেগুলাে যেন ভবিষ্যতে ইতিবাচকভাবে জীবনে কাজে আসে তাই চাই

Tasfia Tabassum Toishi

School & College

GB010

LEAVE REPLY

Your email address will not be published. Required fields are marked *