নিজেকে কাজের মধ্যে রেখেছি

আমাদের কারও এ-কথা জানতে বাকি নেই যে, দুনিয়াব্যাপী করোনা মহামারি জেঁকে বসেছে। এবং খুব তাড়াতাড়ি সেটা এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায়ও নিচ্ছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য; যাতে

পৃথিবীবাসীকে এই মহামারির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু ঠিক কবে নাগাদ আমরা ভ্যাকসিন হাতে পাবো এবং এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি পাবো সেটা বলার উপায় নেই। নানান সময়ে পৃথিবীর বুকে ভয়াবহ মহামারি আঘাত হেনেছে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত করে একসময় সেটা বিদায় নিয়েছে। কিছু কিছু মহামারি বছরের পর বছর পৃথিবীতে ছিলো যা প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকার কিছুই সম্ভব হয়নি। মানুষ সেসব বিপদ একসময় ঠিকই কাটিয়ে উঠেছে এবং পরবর্তী প্রজন্ম আবার নতুন করে সভ্যতা গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়েছে। চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে করোনাভাইরাস পৃথিবীর প্রায় সকল জায়গাতেই তার সুগভীর প্রভাব করে মানুষের সীমাহীন কষ্টের কারণ হয়েছে। মানুষের প্রতিরোধহীন মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। এখন পর্যন্ত অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা মহামারি। এই বিপর্যয় শুধু যে মানুষের জীবনের ওপরই এসেছে এমন নয়। এ যেন এক সর্বগ্রাসী যুদ্ধ। এই যুদ্ধ মানুষ জীবন কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ধ্বস নামিয়েছে। পৃথিবীর বহু মানুষ কাজ হারিয়ে চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়েছে।

যখন কোনো বিপর্যয় কোনো মানব বসতিতে এসে আঘাত হানে তখন সেটা যে বিপর্যয় ঘটায় তার সবটুকু চাক্ষুষ দেখা যায় না। কিছু ক্ষত এমন থাকে যা কাউকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। করোনা দীর্ঘস্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করার কারণে আমাদের সেই ভেতরের ক্ষতটা এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মানুষ নানাদিক দিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। আমার মনে হয়, এই মহামারি সবাইকেই কোনো না কোনো দিক দিয়ে ক্ষতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। কেউ তার মূল্যবান জীবন হারিয়েছে, কেউ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে আর কেউবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে সবই একসময় ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো মানুষ কিংবা একটা সমাজ যদি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, মহামারির কাছে নতি স্বীকার করে, তাহলে তার ঘুরে দাঁড়নো খুবই কঠিন। তাই এখন সবার আগে ইতিবাচক মনোভাব  ধরে রাখা জরুরি।করোনার এই সময়টাতে আমরা দেখেছি- অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি: সমাজে যাদের রয়েছে বিপুল

সম্মান ও প্রতিপত্তি, তারা নিজেদের প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছেন এবং নিজের জীবন শেষ করেদিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এর কারণ হলো – হঠাৎ কর্ম হারিয়ে পড়া এই মানুষগুলো ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তারা হারিয়ে গেলেন চিরতরে। কিন্তু এভাবে হারিয়ে যাওয়া তাদের সমস্যার সমাধান হতে পারে না।

সুতরাং এসব বিবেচনায় এখন আমাদের ইতিবাচক মনোভঙ্গি ধরে রাখা কর্তব্য। সেই মার্চ মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে এসে বসে থাকতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়েথাকতে ক্লাস করার পাশাপাশি নানামুখী কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন সময়টা বেশ ভালোই কেটে যেতো কিন্তু বাড়িতে বসে সময়টা পার করা বেশ কঠিনই বটে। আমি মাঝে একবার গিয়ে বইপুস্তক নিয়ে এসেছি। বাড়িতেও বিস্তর বই রয়েছে। কিন্তু শুধু বই পড়ে তো আর

সব সময় পার করা সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী? ছোটবেলায় আমরা প্রবাদে পড়েছি- অলস মস্তিষ্ক হলো শয়তানের আখড়া। অতএব মস্তিষ্ককে অলস রাখার সুযোগ নেই। ফলে কীভাবে আমার সময়টা সুন্দরভাবে কাজেলাগাতে পারি সেটাই আমার মুখ্য চিন্তা হয়ে দাঁড়াল । আমি যখন বাড়িতে আসি তখন পাটের বীজবপনের মৌসুম সবে শুরু হয়েছে। কৃষকের সন্তান হলেও ইতোপূর্বে আমি পরিপূর্ণভাবে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করিনি। কিন্তু এবার বাড়িতে এসেই মাঠে নেমে গেলাম। সারাদিন কাজ

করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই আমি কাজ করতাম সকালে আর বিকালে। ফলে এই দুটো সময় নিয়ে আমার চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। পাটের মৌসুম সহজে শেষ হয় না। বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় জুড়ে কাজ চলতেই থাকে। তাই আমার সময়ের একটা বড় অংশ ওই কাজে ব্যয় করেছি। কিন্তু তা বাদেও আমার হাতে প্রচুর সময়। বাড়িতে আমার দুটো ভাগ্নে থাকে। ওদের পড়াতে শুরু করলাম। ওদের দেখাদেখি পাড়ার আরও দুটো ছেলে পড়তে এলো ফলে সকালের একটা বড় সময় ওদের সঙ্গে কাটানোর সুযোগ হলো । আমার বন্ধুদের একটা বড় অংশ ক্যারিয়ার গড়ায় ব্যস্ত। কিন্তু আমি সব সময় চেষ্টা করি নিজেকে গড়ে তুলতে। ফলে লকডাউনের এই সময়টাতে পরিকল্পনা করে পড়াশোনা শুরু করলাম। লকডাউনের প্রথম ভাগে পড়েছি পাঁচ হাজার পৃষ্ঠা। আর দ্বিতীয় ধাপেও আমার পড়া পৃষ্ঠাসংখ্যা পাঁচ হাজার। এই মোট দশ হাজার পৃষ্ঠা আমি সাহিত্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি- সমস্ত বিষয়ে পড়েছি নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য।

ছোটোবেলা থেকেই আমার লেখালেখির অভ্যাস। গত প্রায় দশ বছর ধরে দেশের জাতীয় পত্র পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখছি। ২০২০ সালের বইমেলায় আমার প্রথম বই বের হয়। সুতরাং লেখালেখিটা আমার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। লকডাউনের প্রথম দিকে আমি তেমন কিছু লিখতে পারিনি। সে সময় যে কিছুটা হতাশ ছিলাম না সেটা বলা ঠিক হবে না। ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি; আবার লেখা শুরু করেছি পত্রিকায়। এই সময়টাতে আমার প্রায় ত্রিশটির অধিক প্রবন্ধ, ছোটগল্প , ছড়া ছাপা হয়েছে। এই সময়টাতে অনেককিছুই বন্ধ হয়ে পড়েছে। তবে প্রযুক্তি আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই একই বন্ধনে বেঁধে রাখতে সমর্থ হয়েছে। আমি এই সময়ে বেশ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে প্রচারিত হওয়া ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। এটা আমার জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। তাছাড়া অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে। সব সময় চেষ্টা করি ক্লাসে উপস্থিত থাকতে। অনলাইনে হওয়া অনেকগুলো প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহণ করেছি। মজার ব্যাপার হলো কিছু পুরস্কার আমার ভাগেও জুটেছে। আমি এ সমস্ত কাজগুলো করেছি শুধুমাত্র নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য এবং ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার জন্য। আমি জানি, কোনো কারণে জীবন যদি স্থবির হয়ে পড়ে তাহলে হতাশা চলে আসে; যা একজন মানুষকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সময়টা ভালো যাচ্ছে না; আমরা সবাই জানি। তবুও আমাদের ভালো থাকতে হবে। আমাদের আগামীর প্রজন্মের কাছে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়ার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

Arafat Shaheen

University Category

GB039

LEAVE REPLY

Your email address will not be published. Required fields are marked *