দেওয়ালে আটকে থাকা ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে একটার পর একটা দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কোভিড–১৯ শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু হয় নতুন বাস্তবতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের‘নিউজফিড’ বদলে যেতে শুরু করে, অনেকের ‘প্রোডাক্টিভ কাজ’ দেখে হতাশায় ডুবে যেতে থাকি। মানসিক স্বাস্থ্যের যে ব্যাপারটি আমি সারাজীবন দূরে ঠেলে রেখেছি, সেই ব্যাপারটি নতুন করে ভাবাতে শুরু করে। মানুষের জীবন, তার কর্মের সামগ্রিক অর্থ নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয় অফুরন্ত এই অবসর।
প্রথম যে ব্যাপারটি দিয়ে আমার সচেতনতার শুরু হয় সেটি‘সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড’, অর্থাৎ নিজের নিজের মানসিক অবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়া। নিজেকে বুঝতে পারে। কোয়ারেন্টিন বা গৃহবন্দি যাই বলি না কেন এই ব্যাপারটি শুরু হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি, নিজেকে সময় দেওয়া জরুরী। নিজের চিন্তাভাবনাকে লিখে কিংবা বলে বিশ্লেষণ করা এবং নিজের খুঁত, দুর্বলতাগুলো বুঝতে পারা জরুরী।
নিজের সাথে কথা বলে এবং নিজের ব্যাপারে লিখে ঠিক কীভাবে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা যায় সেই ব্যাপারে ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি করতেই চমৎকার একটি বইও পেয়ে যাই। জেমস পেনেবেকার আর জন ইভান্সের লেখা‘Expressive Writing: Words that heal’ বইটি থেকেই শুরু করি যাত্রা। লেখালেখির অভ্যাস আগেও ছিলো কিন্তু নিজের সাথে কথা বলে নিজের অজানা গল্প, মানসিক অস্বস্তির কারণ বের করে আনা যে কঠিন তা বুঝতে থাকি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে। আমাদের অনুভূতির কুয়াশায়, অবচেতনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট ক্ষোভ, হতাশা, অপ্রাপ্তির সাথে যুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে এই ক্ষোভ, অপ্রাপ্তিকে ঢেলে দেওয়া যায় কথায়, বন্ধুদের মাঝে আড্ডায়। কিন্তু লকডাউনে তা হয়ে উঠে কঠিন, তাই এই লকডাউনে এক্সপ্রেসিভ রাইটিং তা নিজেকে অনুসন্ধান করে লেখার চেষ্টা আমাকে মানসিক ভাবে অনেকটাই সুস্থ রেখেছে।
ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করেছি নতুন কিছু শেখার, জার্মান ভাষা শেখা শুরু করেছিলাম অনেক আগেই। অনেকটা অধ্যবসায়ের অভাবে সেই শেখায় মরিচা ধরে যায়। নতুন কিছু শেখায় মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত সচল থাকার জ্বালানি পায়, এই ভাবনা থেকেই জার্মান শিখতে শুরু করি। ফেসবুকের ভাষা ‘ইংরেজি’ থেকে বদলে ‘জার্মান’ ভাষায় পরিবর্তন করে দেই, চিরচেনা ‘Like’, ‘Comment’, ‘Share’ বদলে সেখানে দেখা যায় ‘Gefallt mir’, ‘Kommentieren’, ‘Teilen’। এভাবে ফেসবুক চালাবার সাথে সাথে নতুন ভাষার কয়েকটা শব্দ টুকে নিতে থাকি। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ‘কোর্সেরা’,‘এডেক্স’, ‘ইউডেমি’তে দরকারি কোর্স করার চেষ্টা করেছি, তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কয়েকদিনের মাঝেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় হতাশ হয়েছি। নতুন আরেকটি কোর্স শুরু করেছি, সার্টিফিকেটের খাতা তাই শূন্যই রয়ে গেছে। তবে এই
কোয়ারেন্টিনে সবকিছুতে নিজেকে স্বীকার করে নেওয়ার চেষ্টা থেকে এখানেও ইতিবাচক কিছু শিক্ষা পেয়েছি। একদম মূল ব্যাপারটি ছিলো, অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মের গুরুত্ব আর বিশালতা বুঝতে পেরেছি, ঘুরে ঘুরে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পড়ানোর ধরণ আর পঠন পদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করেছি। এত শিক্ষককে সরাসরি সামনে পাওয়া বাস্তবে হয়তো সম্ভব ছিলো না। ইতিবাচকতার আরেকটি ধাপ ছিলো পছন্দের কাজগুলোতে সময় ব্যয় যে কোনোভাবেই অপচয় নয় সেটি বুঝতে পারা।
প্রিয় উপন্যাস কিংবা কবিতা পড়তে, পছন্দের টিভি সিরিয়ালেচোখ বুলাতে অথবা প্রিয় সিনেমা আরো একবার দেখার সময় সুযোগ আমার কাল নাও থাকতে পারে। এই লকডাউনে এক বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কে কি পড়ছে, কি সিনেমা দেখছে জানার চেষ্টা করেছি। এক বন্ধুর পরামর্শে নাৎসি নির্যাতন শিবির থেকে বেঁচে ফিরে আসা মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাংকলের “Man’s search for Meaning” নামের চমৎকার বই পড়েছি, মানসিকভাবে চাঙ্গা হতে দারুণভাবে সাহায্য করেছে বইটি, সেই বইয়ের দুটি লাইন হয়তো আমার আগামী জীবনের ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে পাথেয় হবে, লাইন দুটি দিয়েই লেখা শেষ করছি।
“Everything can be taken from a man but one thing: the last of the human freedoms- to choose one’s attitude in any givrn set of circusmstances, to choose one’s own way.” (Man’s Search for Meaning- Viktor E. Frankl).
Shah MD. Minhajul Abedin
University Category
GB061