২০২০ এর শুরুতেই আমরা নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম। কোথায় যাব, কখন কী হবে, কখন কী করব, আরও কত কিছু। চীনে যখন করােনা হানা দিলাে, আমরা খুব বেশি আতঙ্কিত হইনি। আতঙ্কিত হওয়ার মতাে আসলে কিছু ছিলও না তখন। স্বাভাবিকভাবেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু করােনা নামক বৈশ্বিক মহামারী যখন বাংলাদেশে শনাক্ত হলাে, তখন হঠাৎ করেই ওলট–পালট হয়ে গেল সব কিছু। দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক সব একসাথে ভর করল আমাদের উপর। করােনা নামক এক আপদের আগমনে জীবনযাত্রা কীভাবে বদলে গেল!
ভার্সিটি যখন বন্ধ ঘােষণা করা হলাে, এক সপ্তাহের পরিকল্পনা নিয়ে বাসায় এসেছিলাম। কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝলাম, এক সপ্তাহ কেন, আগামী কয়েক মাসও ভার্সিটি খুলবে না। সে সন্দেহ এখন সত্যি হয়েছে।
লকডাউন শুরুর দিকে জীবনটা একদম অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমি সাধারণত ঘরকুনাে, তা সত্বেও এমন বন্দিজীবন অসহ্য লাগছিলাে। ভাবলাম, নিজেকে এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে কিছুদিনের মধ্যে মানসিক রােগী হয়ে যাব। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবাে? কোনাে আইডিয়া পাই না, আবার থমকে যাই। এরপর দেখলাম, আমি থেমে থাকলেও পৃথিবী কিন্তু থেমে থাকছে না! পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানাতে না পারলে টিকে থাকা যাবে না। পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে; বইয়ের ভাষায়, যাকে বলে অভিযােজন ক্ষমতা। ডাইনােসর বিশাল প্রাণী হওয়া সত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি, বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাই।
ডাইনােসরের মতাে আমারও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হলাে! কোনাে এক বইয়ে একটি উক্তি পড়েছিলাম। উক্তিটি অনেকটা এরকম: “তুমি যেখানে, যে অবস্থায় আছাে সেখান থেকেই শুরু করার চেষ্টা করাে। হয়তাে তােমার ক্ষমতা এখন সীমিত, কিন্তু মনে রাখবে সীমিত থেকেই প্রাচুর্যের শুরু।“
যেকোনাে সংকটে ইতিবাচক থাকাটা সত্যিই কঠিন, কিন্তু এটা খুব জরুরী। ইতিবাচক থাকতে না পারলে নিজের জন্য ও অন্যের জন্য যা করতে চাই, সেগুলাে ঠিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। সেকারণে নিজেকে ভালাে রাখা খুব জরুরি। আজ আপনাদের সাথে কিছু বিষয় শেয়ার করব। এগুলাে কোনাে উপদেশ নয়। এই করােনা মহামারীতে নিজের জীবনে এগুলাে প্রয়ােগ করে দেখতে পারেন, কিছুটা হলেও উপকার পাবেন। আমি এভাবে নিজেকে এখন। পর্যন্ত সুস্থ রাখতে পেরেছি।
★ সুবিধামতাে দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করে নিয়েছি:
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা যেন একদমই বেকার! পুরাে সময়টা যেহেতু বাসায় কাটাচ্ছি, তাই বাসায় আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের সবার জন্য একটি দৈনন্দিন কাজের রুটিন তৈরি করে নিয়েছি এবং সেভাবে চলতে চেষ্টা করছি। এর মাধ্যমে নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে না, হতাশাও ভর করছে না।
★ স্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস গড়ে তুলেছি:
করােনাকালের এই সময়ে যেহেতু আমরা বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছি, তাই আমাদের সবার উচিত স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখা। শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়ার এইতাে সুযােগ। এই সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানাে এবং হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে অঙ্গপ্রতঙ্গ সচল রাখা। বাইরের খাবার এবং কোল্ড ড্রিঙ্কসের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল আমার, এবার সেটা বাদ দিতে পেরেছি।
★ প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছু সময়:
ভােরে বা সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটার অভ্যাস মানুষের জীবনধারাই বদলে দিতে পারে, এই কিছুদিন আমি সেটাই অনুভব করেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে জমির সবুজ রাস্তা ধরে হেঁটেছি। গাছ, ফুল, পাখির ডাক, হাঁস–মুরগির ডাক, প্রকৃতির হাওয়া সত্যিই মন ভালাে করে দেবে আপনার। সকালটা ভালাে কাটলে পুরাে দিনটিই ভালাে কাটে।
★ কৃষক হয়ে গেলাম:
বাড়ির চারপাশে কিছু পতিত জমি ছিল। লকডাউনের শুরুতে ভাবলাম, এগুলাে কাজে লাগাতে হবে। চাষাবাদ সম্পর্কে তাে আমি এক্সপার্ট না, তাতে কী হয়েছে! বাবার সাহায্য নিলাম, আর সব সমস্যার সমাধানের জন্য ইউটিউব, গুগল মামা তাে আছেই! লাগিয়ে দিলাম হরেক প্রজাতির বীজ। এখন সেগুলাে থেকে বরবটি, ধুন্দুল, করলা, রেস, পুঁইশাক হয়েছে; বাজার থেকে যেন আর সবজিই কিনতে হচ্ছে না!
★ পছন্দের কাজগুলাে করার মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি:
একেক জন একেকভাবে নিজের ভালাে লাগা খুঁজে নেয়। তাই আমিও নিজের মতাে করে চাপমুক্ত থাকার উপায় বের করে নিয়েছি। দুর্যোগের এই সময় নিজেকে ভালাে রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি। দীর্ঘদিন তাে বই–খাতা ছাড়া আছি। ভাবলাম, এখন যেহেতু পড়াশােনার এত বেশি চাপ নেই, দেখি নিজের কোনাে প্রতিভা বের করে আনা যায় কিনা। বিভিন্ন লেখালেখি, কুইজ প্রতিযােগিতায় অংশ নেয়া শুরু করলাম। এখন যেমন এই ব্লগ রাইটিং প্রতিযােগিতায় অংশ নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, এই কয়দিনে পঞ্চাশটার বেশি সার্টিফিকেট পাওয়া গেল, সাথে অল্পস্বল্প প্রাইজমানি তাে আছেই। মুজিববর্ষের ছয় দফা অনলাইন কুইজ প্রতিযােগিতায় অংশ নিয়ে দশ হাজার টাকা পুরস্কারও পেলাম। ইতােমধ্যে প্রায় ৫০ টা নন–ফিকশন বই পড়ে শেষ করেছি। মজার ব্যাপার হলাে, কিছু বইয়ের রিভিউ দিয়ে পুরস্কারও পাওয়া গেছে!
★ নিজের দক্ষতা বাড়ানাের চেষ্টা করেছি:
করােনাকে অভিশাপ হিসেবে না নিয়ে শাপে বর হিসেবে গ্রহণ করেছি। এমন অনেক কাজ আছে, যেগুলাে আগে কখনাে করিনি বা করার সুযােগ হয়নি, সেগুলাে করার চেষ্টা করেছি। ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স শুরু করেছিলাম (এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে আছি), কিছুদিনের মধ্যেই একটা অনলাইন বিজনেস দাঁড় করানাের প্ল্যান আছে। মনে হচ্ছে,
করােনা পরবর্তী পৃথিবী সম্পূর্ণ অনলাইন হবে, অনলাইন কেনাকাটাও বাড়বে। মাইক্রোসফট এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট শিখে নিয়েছি। এখন এডবি ইলাস্ট্রেটর শেখার পরিকল্পনা আছে।
★ পরিবার ও প্রিয়জনের জন্য অফুরন্ত সময়:
কর্মব্যস্ত জীবনে আমরা আমাদের পরিবারকে খুব বেশি সময় দিতে পারি না। এবার হাতে অফুরন্ত সময় পেয়েছি। ছােট ভাই–বােনগুলােকে পড়া দেখিয়ে দিচ্ছি, তাদের সাথে খেলছিও! একটু রান্না শিখতে চেয়েছিলাম, মা রান্নাঘরে ঢুকতেই দিলাে না!
★ ধর্মীয় প্রার্থনা: নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় প্রার্থনা সবারই করা উচিত। মানসিক চাপ কমানাের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রার্থনা বেশ কাজে দেয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও এটি প্রমাণিত। ধর্মীয় প্রার্থনায় মন শান্ত ও স্থির হয়। নামাজটা ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। পবিত্র কুরআন শরীফ বাংলা অনুবাদ পড়া শুরু করেছি; এখন ১৭ পারায় আছি! যার যার ধর্মগ্রন্থ জীবনে একবার হলেও বুঝে পড়া উচিত!
★ সােশ্যাল মিডিয়ার পরিমিত ব্যবহার:
লকডাউনের শুরুতে সারা দিন–রাত বাসায় অবস্থানের কারণে সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে একটু বেশি সময় কাটিয়েছিলাম। সারারাত ফেসবুক চালিয়ে, মুভি দেখে ভােরের দিকে ঘুমিয়েছি, দুপুরে ঘুম থেকে উঠেছি। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে কয়েকদিন চালিয়ে যাওয়ার পর অবসাদ আর হতাশা ভর করতে বেশি সময় লাগলাে না। আর তখনই একটি রুটিন তৈরি করে নিয়েছিলাম।
★ সকলের তরে সকলে আমরা:
শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই কী হবে? এখন তাে মােটামুটি সবার আর্থিক অবস্থাই খারাপ। আশেপাশের অসহায় মানুষগুলাের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পাই। আমার নিজের খুব বেশি সামর্থ্য নেই, বন্ধুবান্ধবরা মিলে কিছু টাকা তুলে লকডাউনের সময় কয়েকটা পরিবারকে চাল–ডাল কিনে দিয়েছিলাম। বন্যার সময়ে, বন্যাদুর্গত পরিবারের পাশে দাঁড়ানাের উদ্দেশ্যে আরও কিছু টাকা–পয়সা তুলেছিলাম, চেষ্টা করেছি সাধ্যমতাে। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চাই। একটা অসহায় মুখের একটুখানি হাসি অনেকদিন ভালাে থাকার রসদ যােগায়।
★ মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে:
আমাদের জীবনে সময়ের ভালাে–খারাপ আসে। জীবনে উত্থান–পতন তাে থাকেই। নানা সময় সমস্যা আসে, আবার তা সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। বেশি চিন্তা করলেই যে তা খুব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এমনও নয়। তাই অহেতুক চিন্তা বাদ দিয়েছি। সেশনজটে পড়ব কী পড়ব না, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। নিয়ম তাে সবার জন্যই এক! মানবজাতি আজ যে দুঃসময় পার করছে, অতি শীঘ্রই হয়তাে এর অবসান হবে। কেটে যাবে এই অমানিশা ঘেরা
রাত, আসবে একটি সুন্দর ভাের। একসাথে ফের সবার পদচারণা হবে আমাদের চিরচেনা পথে– এমনটাই প্রত্যাশা করছি সবাই।
তাে, এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময়। জীবন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। অনেকেই প্রকৃতিকে গালি দিচ্ছি, স্রষ্টাকে দোষারােপ করছি। এটা ঠিক আছে যে, করােনা সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছে; তবে এটা শুধু আমার কিংবা আপনার একজনের জন্য না, পৃথিবীর সবার জন্যই। করােনাকে প্রথমে অভিশাপ হিসেবে নিলেও এখন আশীর্বাদ হিসেবেই ধরে নিয়েছি। বিগত ছয় মাস এমন কিছু পেয়েছি বা শিখেছি, অন্য সাধারণ সময় হয়তাে সেটা পাওয়া যেত না। বস্তুত, আল্লাহ যা করেন ভালাের জন্যই করেন।
আমেরিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন বলেছিলেন, “সময়কে যদি ঠিকমত ব্যবহার করা যায়, তবে কেউই সময় নিয়ে অভিযােগ করবে না। তুমি যদি সময়কে ঠিকমত ব্যবহার করাে, তবে কাজের পরিমাণ দেখে তুমি নিজেই অবাক হয়ে যাবে।” কোয়ারেন্টাইনের ঘরবন্দি এই দিনগুলােতে করােনা ভাইরাসের অজুহাত দিয়ে আমরা যেন আমাদের মূল্যবান সময়গুলাে নষ্ট না করে ফেলি! এই আফসােসটুকু যেন পরবর্তীতে করতে না হয় যে, করােনা আমার মূল্যবান সময়গুলাে নিয়ে চলে গেল!
=======================================================
জাহিদ হাসান
University Category
GB111