‘কিছুই ভালো লাগছে না আমার’, ‘অসহ্য’, ‘আর কতদিন এভাবে বসে থাকব’, ‘পড়াশোনা একদমই হচ্ছে না আমার’ – লকডাউনের শুরুর দিকে এগুলোই ছিল আমার নিত্যদিনের কপচানো বুলি। আর হবেই না বা কেন, এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র ১৫ দিন আগে যখন জানতে পারলাম পরীক্ষাটা অনিশ্চিত, তখন আমার মতো ইন্টার থার্ড ইয়ারে ঝুলে পড়া শিক্ষার্থীদের মুখ দিয়ে এসব কথাই বেরোবে। আর বিশেষত আমার মতো যারা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, শুধু তারাই জানে দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার জন্য কিভাবে দৌড়াতে হয়েছে ট্রেনের মতো। আর সেই ট্রেনটা যখন তার গন্তব্যে পৌছানোর আর এক ষ্টেশন বাকি ছিল ঠিক তখনই করোনা এসে ট্রেনলাইনের উপর অনির্দিষ্টকালের জন্য সিগন্যাল ফেলে দিয়েছে আর দিয়ে শুধু চলে যায় নি, নিজে দাড়িয়েও আছে।এটা কি মেনে নেয়া যায়? যায় না। তবু নিতে হয়েছে সবার৷ আমিও নিয়েছি। হ্যাঁ, প্রথম দুই মাস অসহ্য লাগলেও মনকে বুঝিয়েছি। কারণ হাজার কান্নাকাটি করলেও তো লাভ হবে না। আসলে আমাদের মতো স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী যাদের দিন কাটে দৌড় ঝাপ,খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা,গল্প,খুনসুটি আর পড়াশোনা নিয়ে, তাদের কাছে এই ঘরবন্দি জীবন যেন বিনা দোষে জেল খাটা।
যাই হোক, আমার নিজের কথাই বলি। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হলেও পরিবারের সহযোগিতা আর নিজের চেষ্টায় মনকে এই নতুন পরিস্থিতিতে দৃঢ় রেখেছি। চারিদিকে কোভিডের এই ভয়াল রূপ দেখেও মনকে ভেঙে যেতে দেইনি। এটা ভেবে নিজের মনকে বুঝিয়েছি যে, বেঁচে থাকাটা দরকার। নইলে ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলো তো হা-হুতাশ করবে এই প্রজন্মের অভাবে।গত ছয়মাস প্রয়োজন ছাড়া একদমই ঘরের বাইরে যাইনি। সারাদিন পাঠ্যবই না পড়ে কিছুটা সময় কাটিয়েছি রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণের উপন্যাস আর সুকুমার রায়ের হাসির গল্প পড়ে। আসলে বইয়ের মাঝে হারিয়ে গিয়ে কিন্তু বাহ্যিক দুঃখ কষ্ট অনেকটা ভুলে থাকা যায়৷ মা, বাবা, ঠাকুমা, দিদির সাথে এক জায়গায় বসে গল্প করেছি। গান শুনেছি, মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমা দেখেছি। তাছাড়া, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ২০-২৫ মিনিট করে যোগব্যায়াম করেছি যা আমাকে শারীরিক ও বিশেষ করে মানসিকভাবে সুস্থ রেখেছে। তবে এত কিছুর মাঝেও সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে ভুলিনি। বরং তার নাম নেয়াতেই পাওয়া যায় অপার শান্তি, বেঁচে থাকার ইচ্ছা। আর এসব করেই সারাদিন মনকে প্রফুল্ল রাখতাম।
এছাড়া বাড়ির অদূরে আছে নদী। প্রায়ই ভোরবেলা ও সন্ধার আগে যখন সেখানে লোকজন কম থাকতো বা থাকতো না,তখন গিয়ে একটু হাটাহাটি করে আসতাম। সর্বোপরি, আমার নিজের ইচ্ছাতেই আমি আমার মনকে স্থিতিশীল রাখতে পেরেছি। এই কারণে আমি মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক হতে সুস্থ আছি এবং পড়াশোনা চালু রাখতে পেরেছি।আমার মনে হয় একজন মানুষ যা করতে চায়, তা যদি খুব অসম্ভব না হয়, তবে তা চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। তাই এই মহামারীর মধ্যে নিজেকে মানসিকভাবে স্থিতিশীল রাখাটা কঠিন কিছু নয়। আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াসই পারে তা সম্ভব করতে।
Krishna Paul
School & College Category
GB049