একজন মানুষ ঠিক কতটা ইতিবাচক তা বােঝার উপযুক্ত উপায় হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে সংকটময় মুহুর্তে জীবন নিয়ে তার উপলব্ধি বােঝা। পৃথিবী জুড়ে কোভিড–১৯ মহামারী যেভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপন্ন করে তুলেছে, এসময়ে নিজের ইতিবাচক মনােভাবটুকু বাঁচিয়ে রাখা বেশ কঠিন হলেও ঠিক এই সময়েই এটি অত্যন্ত জরুরী। মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ‘লকডাউন‘ আর ‘কোয়ারেন্টাইন‘ শব্দদুটি যেন সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জীবনকে এক অনির্বচনীয় দুর্দশা, আতংক আর একাকীত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ মহামারীতে মৃত্যুর সাথে সাথে বেড়ে গেছে হতাশায় আত্নহত্যা এবং বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ। একজন ইতিবাচক মানুষ হিসেবে তাই এই সময়ে নিজের অভিজ্ঞতাটুকু শেয়ার করা কিছুটা হলেও ইতিবাচক ফল দেবে বলে আমি আশা করি।
প্রতিদিন মৃত্যুমিছিলে ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া সংখ্যাটুকু অনেকের কাছে নিছক সংখ্যা হলেও মৃত মানুষের পরিবারের জন্য তা কতটা অসহনীয় যন্ত্রণার হতে পারে , এটা মনে করে এই সময়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বহুগুনে বেড়ে গেছে কারণ বােনের সদ্যোজাত বাচ্চাটাসহ পরিবারের পাঁচটা প্রাণ আমরা এক ছাদের নিচে থাকার সুযােগ পেয়েছি অনেকদিন পর। যেখানে আমার সন্ধ্যাগুলাে কাটতাে ক্যাম্পাসের কোলাহলমুখর আড্ডায়, টংগুলাের চায়ের কাপে কিংবা বিভিন্ন ফাস্টফুডের স্বাদ উপভােগে, সেখানে বিগত সাত মাসের সন্ধাগুলােয় আমি জেনেছি বাবা চিনি খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, মায়ের কাপে আধা চামচ চিনি হবে, বাচ্চাটা নতুন চা খাওয়া শিখছে, তাকে ভালােমত ঠান্ডা করে চা দিতে হবে। আমি বাইরের ফাস্টফুডগুলাের গল্প করতে গিয়ে ভেবেছি, নিজেই একবার ট্রাই করি না কেন! ইউটিউব দেখে বিভিন্ন নাস্তার রিহার্সাল, কখনাে পুড়ে যাওয়া সিংগারার আফসােস আবার কখনাে দারুণভাবে বেকড হওয়া স্পঞ্জ কেক খেয়ে মায়ের প্রশংসা আমাকে জানান দিয়েছে জীবন কি অসম্ভব সুন্দর। লকডাউনে যখন সমস্ত শপিংমল বন্ধ, বাচ্চাটার প্রথম ঈদের নতুন জামা নিজ হাতে বানানাের সময় সুচের প্রতিটা ফোঁড়ে আমি জীবন দেখেছি, নতুন জামা পড়ে এই অবুঝ শিশুটির নিস্পাপ হাসি, তার মায়ের নির্মল আনন্দে আমার ঈদ হয়ে উঠেছে জীবনের সেরা ঈদ৷
এর আগের ঈদগুলােয় যেখানে গেস্ট সামলাতে গিয়ে বন্ধুদের কল রিসিভ করা হয়ে উঠতাে না, এই ঈদে বন্ধুদের নিয়ে গ্রুপ ভিডিওকলে আমরা একে অন্যের কাল্পনিক মােটা হয়ে যাওয়া নিয়ে খুনশুটিতে মেতেছি৷ নিজের মন খারাপের সময়গুলােতে বন্ধুদের পেয়েছি, তাদের হতাশার সময়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি৷ একে অন্যের প্রায় মিইয়ে আসা গুণগুলােকে নতুন করে আবিষ্কার করে সেগুলাে নিয়ে উৎসাহ দিয়েছি৷ আমার অনেক বন্ধু লকডাউনে নিজের অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছে৷ তাদের প্রথম রােজগারের দিনের হাসিমুখগুলাে কি প্রচন্ড প্রশান্তির!
দীর্ঘদিন সেলফে ধুলাে জমে মলিন হয়ে আসা বইগুলাের সাথে আমার পুনর্মিলন হয়েছে এই লকডাউনের অলস সময়গুলােয়। ছােটবেলায় প্রায় না বুঝেই পড়ে ফেলে বইগুলাে নতুন করে পড়েছি, একই বইগুলাের দারুণ জীবনদর্শন নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি৷ যত্নের অভাবে ছাদের গাছগুলাে যখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল, বিকেলগুলাে তাদের মান ভাঙাতে কাটিয়েছি৷ সামান্য একটু যত্ন ও ভালােবাসায় তারা সর্বাঙ্গে বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটিয়ে হাসতে শিখেছে। কোনাে এক দুপুরের হঠাৎ বৃষ্টিতে বারান্দার ক্যাকটাসগুলাে সরাতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে আমি কি ভীষণভাবে সুখী।
সর্বোপরি মহামারীর এই ঘরবন্দীর সময়গুলােতে আমি জেনেছি ভালাে থাকার জন্য যা দরকার তা হচ্ছে ভালাে থাকার ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে আশেপাশের খুব। ক্ষুদ্র জিনিসগুলাে নিয়েও জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলাে কাটানাে যায়, যন্ত্র আর যান্ত্রিকতার এই দুনিয়ায় পরিবারের মানুষের মুখের হাসি, সদ্য হামাগুড়ি দেওয়া শিশুর কলকল ধ্বনি যে অপার্থিব সুখের সাগরে আপনাকে ভাসিয়ে দেবে, সেটি অনুভব করার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। আপনার ইতিবাচক মনােভাবকে বাঁচিয়ে রাখুন। পৃথিবী আবার সুস্থ হবে, যান্ত্রিকতা আবার আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে, কিন্ত ইতিবাচক হওয়ার দরূণ আপনার সুখভান্ডারের সবচেয়ে দামী রত্ন হিসেবে এই সময়টুকুকে আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন একসময়৷ জীবনসায়াহ্নে আয়নায় নিজের সাথে সুখী কথােপকথনের সময় মনে হবে ‘জীবন সুন্দর!”
Tasnim Rezwana Haque Khan
University Category
GB102