জীবন তার স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধু-বান্ধব,পড়াশোনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। হঠাৎ করে এক দমকা ঝড়ো হাওয়া জীবনের গতিকে লন্ডভন্ড করে দিলো।প্রতিদিন রুটিনে ছন্দ পতন ঘটলো। সে ঝড়ো হাওয়া আর কিছু নয় নোভেল করোনা ভাইরাস।যাকে কোভিড -১৯ ও বলা হয়। ৩১ শে ডিসেম্বর নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে চীনের কতৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানায়, ১১ জানুয়ারি চীনে করোনা ভাইরাসে প্রথম একজনের মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে চীনসহ, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন,ইরান, ফ্রান্স, ভারত,বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৩ টির বেশি দেশে বিস্তার লাভ করেছে মহামারি করোনা।বাংলাদেশে সর্বপ্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ ই মার্চ। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের স্থায়িত্ব ৬ মাস যাবৎ। গত বুধবার ২৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে মতে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৩,৫৩,৮৪৪ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যা মোট ৫,০৪৪ জন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যেন দিন বেড়ে চলছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনায় মৃত্যুর মিছিল। টিভি, খবরের কাগজে চোখ বুলালেই দেখা যায় প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল।প্রথম দিকে যখন চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস মহামারী তখন বাংলাদেশে বসে আমি ভেবেছি চীনে করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশে হয়তো আসতে পারবে না। আমার এ ধারণা খন্ডাতে তেমন সময় লাগে নি। হঠাৎ করেই ৮ ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।আমি ১৮ তারিখ সকাল বেলায় বাসার পথে যাত্রা করি। বিকেলের মধ্যে পৌঁছেও যায়। প্রথম কয়েকদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয় ঈদের বন্ধ দিলে যেমন করে অলস জীবন কাটাতাম ঠিক তেমনই কাটিয়েছি।হঠাৎ করেই দেখি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক হতে শুরু করছে। বিভিন্ন এলাকা লক ডাউন করা হচ্ছে। সেইসাথে দোকানপাট, অফিস-আদালত সবই লক ডাউন।এমতবস্থায় টিভি, খবরের কাগজ,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতাম করোনার খবর। মাঝে পরিস্থিতি এমন ছিলো যে শুধু করোনা নিয়েই চর্চা হতো সর্বত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুজবও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।এসব নিয়ে দিন পার করছিলাম। হঠাৎ করেই ৪মে, সোমবার আমাদের বাড়ি প্রশাসন লক ডাউন করে দিয়েছে। আমাদের বাড়ির এক প্রতিবেশী করোনায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে।তাই ৪মে সোমবার প্রশাসন থেকে ছয় সাত জন লোকজন এসে আমাদের বাড়ির সামনে একটি পোস্টর লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন । পোস্টারটিতে লেখা ছিল “লক ডাউন”। প্রশাসনের লোকেরা আমাদের বলে দিল :”আমরা খবর পেয়েছি আপনাদের এই বিল্ডিংয়ে করোনা আশঙ্কাজনক রোগী রয়েছে।তাই আমরা আপনাদের লক ডাউন করে দিচ্ছি।আজ (৪মে -১৯ মে) মোট ১৫ দিন আপনারা কেউ বাহিরে বের হতে পারবেন না”।কখনো ভাবি নি যে এমন পরিস্থিতি মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে। সবাই একটু আতঙ্কিত হলো।আক্রান্ত প্রতিবেশীর উপর সবার দৃষ্টি পাল্টাতে শুরু করলো। এমন সময় নিজের যে ভয় লাগে নি তেমনটি নয়। তবে, আমি ভাবলাম আপুর অল্পবয়সী , আজ যদি আপুর করোনা পজিটিভ হয়, কাল আমারো হতে পারে। আমার পরিবার বা আপনজনেরা আক্রান্ত হতে পারে। আপু যদি নিজের মনোবল ধরে রাখতে পারে তবে আমি কেন পারবো না। এরপর থেকে পরিবারের সবাইকে করোনাকালীন কি কি মেনে চলতে হবে সে বিষয়ে প্রায়ই বলতাম। নতুন কতজন করোনা থেকে সুস্থ হচ্ছে তার আপডেট সবসময় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। গুজবে যাতে আমার পরিবার ভায় না পায় সে দিকটাও লক্ষ্য রাখতাম। পাশাপাশি আপুকে নুয়মিত ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিতাম। আপুর পরিবারেরও খোঁজ নুতাম। আপুকে সাহস যোগাতাম।আপু করোনা পজিটিভ এজন্য আমার বা আমার পরিবারের কখনো দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয় নি। বরং তাকে সাহস যোগানোর মাধ্যমে নিজে সাহস পেতাম। যেহেতু করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসলেই করোনা হওয়ার সম্ভবনা বেশি তাই আত্নীয় স্বজন ও আশেপাশে অন্য প্রতিবেশীদের ফোনের মাধ্যমে সতর্ক করেছিলাম যাতে আমাদের বাসার আশেপাশে তারা না আসে।পরবর্তীতে আল্লাহর অশেষ রহমতে আপুর আবার করোনার নমুনা পরীক্ষা করানো হয়, আপুর করোনা নেগেটিভ আসে।কিন্তু আপুর করোনা পজিটিভ ইতিমধ্যে আমাকে অনেক ইতিবাচক সাহস জুগিয়েছে। আবার বন্ধের পরিসর বাড়তেই থাকলো তখন ভেবেছি আর বসে থাকলে চলবে না। সামনে আমাদের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাই অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করেছি, আর্টিকেল পড়ছি,আর্টিকেল লেখার চেষ্টা করছি,বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ খবর নিয়েছি। সেইসাথে বেশ কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছি যেগুলোর যত্ন নিতে হয়, মাঝেমাঝে অবসর সময়ে বই পড়েছি, টিভি দেখেছি, সাদে ঘুড়ি উড়িয়েছি, নতুন রান্না শিখেছি। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংগঠনের সাথে ছিলাম সংসঠন থেকে ফান্ড কালেক্ট করেছি। অতঃপর অভাবী মানুষের নিকট ফান্ডগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমি বলবো, আমি করোনা ভাইরাসের এই মহামারি সময়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার মধ্য নিয়ে, করোনাকে ভয় না পেয়ে করোনাকে জয় করা এই মানসিকতাকে ধারণ করে নিজের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব ধরে রেখেছি। আমি এখনো বিশ্বাস করি, করোনা কাটিয়ে আমার সবাই একদিন আশার আলো দেখবো। খোলোস খোলছে ধীরে, জোয়ার আসুক ফিরে। আর আমরা সবাই মিলে করোনা জয় করবো।আমি আশা রাখি আমাদের সবার প্রত্যাশা কখনো বিফলে যাবে না। করোনা আমাদের নতুনভাবে বেঁচে থাকার দিশা দেখিয়েছে। আর নিউ নরমালই হবে নতুন ছন্দের বাহন।
Khandakar Nayma Akter Noon
University
GB026