অনেককেই ফেসবুকে স্টোরি দিতে দেখতাম বছরে দুইবার ছয়মাসের ছুটি চায় তারা। করোনা নামের এই ছোট্ট ভাইরাস কতসহজেই সেই অসম্ভব উইশটিকে সম্ভব করে দিল, নিজে বিশ্বভ্রমণ করে, সবাইকে আটকে দিলো ঘরের মাঝেই।
ছুটি পেয়ে তাই সবাই নাচতে নাচতেই চলে এসেছিলাম ঘরে। এরপর যখন আস্তে আস্তে কোভিড–১৯ এর ভয়াবহতা দেখতে শুরু করলো মানুষ? অচেনা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটা যখন নিজের আপনজনদের মাঝেই চলে আসলো? কিংবা যাদের এখনো কোভিড–১৯ ছুঁতে পারেনি তাদের মনে যে অজানা আশঙ্কা? এতকিছুর মধ্যে ইতিবাচক মনোভাবে ধারে রাখা টা কি সম্ভব? আমি কি করে ছিলাম?
প্রথম কদিন শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলাম,এত বন্ধ পাইনি কয়েকবছর। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই দেখতাম পরিচিত বন্ধুরা নানা চ্যালেঞ্জে ট্যাগ দিত, কখনো বা ছাটবেলার ছবি দেওয়ার চ্যালেঞ্জ, কখনো বা আকাশ–ফুলের সাথে ম্যাচিং করে ছবি দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। ভালোই লাগতো এই দুঃসময়েও তারা মানসিক ভাবে ভালো থাকার কারণ খুঁজে নিচ্ছে।
এরপর দেখলাম সবাই রান্না শুরু করলো, ডালগোনা কফির ট্রেন্ড শুরু হলো, সেই সাথে শুরু হলো আরেকদলের ট্রল করা।চেষ্টা করতাম সব নেগেটিভিটি থেকে দূরে থাকতে। আমার একটা জিনিস খারাপ লাগতেই পারে, কিন্তু তাতে যদি কারো ক্ষতি না হয়, শুধু শুধু অন্যের আনন্দ নষ্ট করবো কেন?
বাসায় থেকে আমিও টুকটাক রান্না শুরু করলাম। বাসার কাজে মাকে সাহায্য করা, নতুন কিছু বানিয়ে খাওয়াতে যে এত আনন্দ আগে জানতাম না।
আমরা এত মানুষের সঙ্গ কামনা করি অথচ খুব কম সময়ই নিজেকে দেই। আমি নিজেকে সময় দেওয়া শুরু করলাম।নিজের ছোটো ছোটো ভালো লাগার কাজ, ছোটবেলায় ফেলে রাখা শখের কাজ নতুন করে করলাম। বই–মুভি যা পড়ব–দেখব বলে জমিয়ে রেখেছিলাম সেই বাকেট লিস্টও পূরণ করে নিযেছি এক ফাঁকে। নিউজফিডের সবার এত প্রতিভা দেখে আমিও উৎসাহ পেলাম নতুন নতুন কাজ করার। শুরু করলাম ইলাস্ট্রেটর এর কাজ। ইলাস্ট্রেটরে প্রিয়জনদের ছবি আঁকতে যত না কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি আনন্দ পেযেছি তাদের চমকে
এই বিশাল সময়কে কাজে লাগাতে একটি রিসার্চ টিমেও কাজ করেছি রিসার্চ ভলান্টিয়ার হিসেবে। ডাটা কালেকশনের ফাঁকে খোঁজ নিয়েছি ছোটবেলার বন্ধু গুলোর, স্মৃতি রোমন্থন করে হারিয়ে গিয়েছি সেই সুন্দর দিনগুলোয়। ছোটোবেলা থেকেই স্বেচ্ছাসেবী কাজগুলো টানতো খুব, যুক্ত হয়েছি আরো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে। চেষ্টা করেছি এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে থাকার। আমার সামান্য কাজে যদি কেউ উপকৃত হয় ক্ষতি কি? হয়তো তাদের দোয়া আর ভালোবাসাই রক্ষাকবজ হয়ে রক্ষা করবে এই মহামারী থেকে।
এই ফাঁকে আমার একদল বন্ধু বের হলো অসাধারণ কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে, শুরু করলো তাদের ছোট্ট বিজনেস। আমি অমুক, কাজ করছি তমুকের ভীড়ে চেষ্টা করেছি তাদের পাশে থাকার।
এর মাঝেই আসলো অভিনেতা সুশান্তের আত্মহত্যার গল্প, আবার চিন্তা শুরু হলো প্রিয় মানুষগুলোর, আসলেই কি ভালো আছে তারা? খোঁজ নিয়েছি তাদের, চেষ্টা করেছি ঝেড়ে ফেলার, নিজের সব আফসোসের গল্প মাঝেমাঝে অবশ্য আফসোস হতো, বিদ্যানন্দ, পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ কিংবা অন্যান্য চ্যারিটি কাজ গুলো দেখে,সাধ্য থাকলে আমিও হয়তোবড় কিছু করার চেষ্টা করতাম কারণ–আমার কাছে দেশ মানে, এক লোকের পাশে অন্য লোক !
করোনার প্রকোপের শুরু থেকেই প্রতিদিন দোয়া করতাম আমার পরিবার যেন সুস্থ খাকে, তারপরও পরিচিত জনদের থেকে শুরু করে একসময় করোনা পজিটিভ হলো বাবা। এতদিন যেই করোনাকে ভয় পেতাম, হঠাৎ মনে হলো না আমি মানসিক ভাবে করোনার চেয়ে শক্তিশালী, আল্লাহ সহায় হলে এত সহজে হার মানবোনা সেই দুঃসহ ৩৪ দিনে বাবাকে দূরে রেখেছি সকল গুজব খেকে, শারীরিক শক্তির অসহায়ত্বে বাবার পাশে থেকেছি মানসিক শক্তি হয়ে। একসময় ঠিকই করোনাকে জয়ও করে ফেলেছি আমরা।
কাকতাড়ুয়ার বুধার কথা মনে নেই? কলেরা নামক মহামারী কিভাবে বদলে দিয়েছিল বুধাকে? কভটা সাহমী করে তুলেছিল? জীবন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে এই আমরাও অনেক বদলে গেছি। আসলে বদলে ফেলেছি। আমার কাছে মনে হয় বাইরের এই পৃথিবীটা একটা আয়না, আমি যেমন, পৃথিবীটাকে দেখব তেমন! এমনিই তো তার নেতিবাচকভার অন্ত নেই, তাই চেষ্টা করেছি নিজেকেই ইতিবাচক রাখার। যদি বেঁচে থাকি তাহলে হয়তো এই ইতিবাচকভাতেই দেখব সুস্থ পৃথিবীর নতুন সূর্যোদ্য–
–সাবরিনা মনসুর
University Category
GB043