আমি যেভাবে কোভিড-১৯ মহামারীর মাঝে ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখছি

বলা হয় সৃষ্টিকর্তা যখন কোন কিছু ঘটাবেন তখন   তার পিছনে কোন না কোন ভালো কারণ তিনি তাঁর সৃষ্টির জন্য অবশ্যই রাখেন। কোন সৃষ্টির জন্য তা হয়তো অভিশাপ কোন সৃষ্টির জন্য তা আশীর্বাদ তুল্য। কথাটি খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু অসাধারণতার প্রকাশ তখনই হয় যখন কথাটির গভীরে যাওয়া যায়। আমরা বলি ‘Deep meaning’.

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর মহামারীতে পৃথিবী যেমন জর্জরিত তেমনি যেন জর্জরিত মানুষের মন। প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে আরো হাজার হাজার মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যাটা যেন ভয়ংকর আকারে আমাদের মনে প্রতিনিয়ত ভয় ধরিয়ে যাচ্ছে। এত এত দুঃসংবাদগুলোর মধ্য থেকেও যখন কিছু মানুষের মনুষ্যত্বের কাহিনীগুলো উঠে আসে তখন মন ভালো রাখার পথটা খুঁজে ফিরি প্রায়ই। যে করেই হোক ভালো যে থাকতেই হবে! মন আর শরীর যে একে অপরের পরিপূরক।

দার্শনিক  সক্রেটিসের ভাষায় বলতে হলে “সুস্থ দেহের জন্য সুস্থ মন ‘,তাই প্রায় ছ’মাস ঘরবন্দী থেকেও  মন ভালো রাখার বাহানায় এই বলেই নিজেকে স্বান্তনা দেই   যে- সৃষ্টিকর্তা  কোন না কোন  কারণ তাঁর সৃষ্টির ভালোর জন্যই দিয়ে থাকেন।  যেমন  বৈশ্বিক এই মহামারী মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে এলেও প্রকৃতির জন্য তা আশীর্বাদ স্বরুপ।  প্রকৃতির দূষণের হারটা এত যে কমে গেল তা প্রকৃতির জন্য বড্ড প্রয়োজন ছিল। আমরা মানুষরা প্রকৃতির উপর অত্যাচারটা একটু বেশিই করে ফেলেছি বৈ কি! কিন্তু সে আশীর্বাদ মানুষের মন ভালো করতে পারলো না যেন। পৃথিবী  জুড়ে যে প্রাকৃতিক দূর্যোগ তাতে আরো বিপর্যস্ত যেন মানুষ।

অর্থাৎ এত এত দূর্গতিগুলোর মধ্যে মন ভালো রাখা বড্ড দায় হয়ে গেছে। তাই একটু কিছু ভালো খবর মাঝে মাঝে মন ভালো করে দেয় নয়তো নিজের মন ভালো করার উপায়গুলো বেশিরভাগ সময়েই  নিজে নিজে খুঁজে বের করে নিতে হয়।

মনটা ভালো না রাখতে পারলে যে শ্বাসটাকে চালু রাখাই মুশকিল হয়ে যেত!কোলাহলে আর পড়ালেখার ব্যস্ততায় নিজেকে সময়টা ঠিকভাবে যে কখনো দেওয়াই হয়ে উঠেনি তা ঘরবন্দী থাকার ফলে টের পেয়েছি বেশ। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে নানান ব্যস্ততায় এসব চিন্তা মাথায় আসার সময়টাই যে পেত না!

বেভো সাহেবের এই বাণীটি আমার ভীষণ লাগে, ‘যে মন কর্তব্যরত নয় সে মন অনুপভোগ্য।’ তাই চেষ্টা করি ঘরবন্দী সময়টাতে কিছু একটায় ব্যস্ত থাকতে। বিশ্ববিদ্যালয়,ক্যাম্পাস,পড়াশোনা,ঘুরাঘুরি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্প সব করেই সময় কেটে যেত বেশ। কিন্তু কখনো ভাবিনি মায়ের জন্যতো বছরের বেশির ভাগ সময়ই বলতে হলে কোয়ারান্টাইন। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি মায়ের প্রতি কিছুটা  হলেও কর্তব্য পালন করতে।এইতো মাকে প্রতিদিন  খুটিনাটি কাজে সাহায্য করে দেওয়া বিনিময়ে মায়ের একটু হাসি পেয়ে যাই, মন ভালো রাখতে এর চাইতে সুন্দর জিনিস আর কি হতে পারে।

অনেক বন্ধুদের  খুব অভিযোগের ডালপালায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে দেখি।এতটা মাস  ঘরে থেকে তাঁরা একেবারে বিরক্ত,কেউ কেউ ভীষণ হতাশ কিংবা কেউ ভবিষ্যতের চিন্তায় ভীত। বিরক্তি,হতাশা,ভয় এসব এই পরিস্থিতিতে  স্বাভাবিক বৈ কি। কারণ কোভিড -১৯ যেন আমাদের সাজানো রুটিনটাকে একেবারে এলোমেলো করে দিচ্ছে। কিন্তু আমি নিজেকে সময় দিচ্ছি, লাখো আক্রান্তের ভিড়ে,লাখো মৃত্যুর মিছিলে আমাদের কিংবা আপনজনদের নামটি নেই তা ভেবে কি এসব অবাঞ্ছিত  বিষয়গুলোকে মন থেকে দূর করা যায় না? এসব অবাঞ্ছিতরা যখনই মনে ঠাই নেয় তখনি বাবার ছোট্ট লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে সোজা ছাঁদে চলে যাই।শহরের ইট-পাথর ফেড়ে যে নিয়ন আলো ছাঁদের  ছোট ছোট গাছগুলোর ওপর এসে পরে তারই পাশে বসে যাই। কখনো হুমায়ুন আহমেদের ‘হিমু সমগ্র ‘পড়তে পড়তে তার পাগলাটে সহযোগী হয়ে  যাই কখনো বা ‘মিসির আলীর ‘ভারিক্কি ভাব ধরি আবার কখনো প্রিয় লেখক ‘সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘ভ্রমণ কাহিনি পড়ে কল্পনার ভ্রমণে   পুরো বিকেল কাটিয়ে দেই, কখনো বা সন্ধে! ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে আর মনকে কিছুটা সময় ভুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বইয়ের জায়গাটা আর দ্বিতীয় কেউ নিতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

খুব বেশি যখন চিন্তারা এসে হানা দেয় মস্তিষ্কে, তখন রান্নাঘর হয় আমার দখলে।সেদিনটা রান্নাঘরে গবেষণা করেই কাটিয়ে দেই বেশ।চিন্তার কী সাধ্য তখন মাথায় নেতিবাচক মনোভাবকে জায়গা দেয়! মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টুকটাক লেখালেখি কিংবা আমার ছোট্ট সেলফোনখানাকে সঙ্গী করে ছাঁদে উঠে  প্রকৃতির রুপকে চারকোনা বাক্সে ধারণ করার চেষ্টায় কাটিয়ে দেই   প্রায়ই। হয়তো কখনো নিজের ব্যস্ততা আর রুটিনের কথা ভেবে ভীষণ আফসোস হলে রং তুলি নিয়ে কিছুক্ষণ আঁকিবুকিতে কাটিয়ে দেই,বারান্দার  ক্ষুদ্র গাছদের সাথে কাটাই নয়তো নিজের ব্যর্থতার ফাঁকফোকর কাটাতে কাটাতেই পুরো দিনটা কিভাবে যেন শেষ হয়ে আসে টেরই পাই না!

এ-ই তো, এ-ই ভাবে দিনগুলো যাচ্ছে আমার। কিংবা আমার না বলে, বলা ভালো আমার মনের। মনকে সবসময় ইতিবাচকতার দখলে হয়তো রাখা খুব মুশকিল হয়ে পরে কিন্তু খুব অসম্ভব তা নয়। মূলত, যে কাজগুলো নিজের করতে ভালো লাগে সে কাজের মধ্যে থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি এই কোভিড -১৯ মহামারীতে প্রতিনিয়ত নিজের   মনকে ইতিবাচকের দখলে রাখতে।

Tamanna Begum

University Category

GB069

LEAVE REPLY

Your email address will not be published. Required fields are marked *