অপেক্ষার আঙিনায় সুর্যাস্ত শেষে
নিরাশার আকাশে বুনি আশার আলো,
দীপ্তির ধরা ছোঁয়ায় যদি আসে
ইচ্ছে ডানার নির্ভরতা ফিরবেই জানি।
আজ পুরো বিশ্ব এক অদৃশ্য শত্রুর সাথে লড়াই করছে যার নাম কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। এ শব্দটি গত কয়েকমাস ধরে আমাদের প্রতিটি দিনের সাথে জড়িয়ে আছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ ১৮ই মার্চ থেকে কোয়ারেন্টাইনে আছি। কেউ জানে না কবে এই অবরুদ্ধ দিনের শেষ হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে ভেঙে পড়লে চলবে না; আমাদের লড়াই করে যেতে হবে এই দুর্বিষহ দিনের অস্ত পর্যন্ত, কেননা ভাস্বর সকাল আসবেই।
লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে আমি ঢাকার হাজারীবাগে আমার পরিবারের সাথে আছি। শুরুতে, এই সময়টি আমার কাছে খুব উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। বেশ একটা ছুটির আমেজ ছিল। তবে তা কয়েকদিন পরই কর্পূরের মতো উবে গেল। হঠাত একদিন খেয়াল করলাম আমি আমার ক্যাম্পাস এবং বন্ধুদের খুব খারাপভাবে মিস করছি। কিন্তু ইচ্ছে পুরণের যে উপায় নেই। আর একথা তো সবারই জানা যে পাখিটি ডানাগুলি টুকরো টুকরো করে রাখলে কতটা কষ্ট হয়! তারপরও আমি হতাশার সমুদ্রে নিজেকে ডুবতে দেই নি। মনে আশা যুগিয়েছি, মহামারী পরবর্তী নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রেখেছি।
আমার জন্য এই বিচ্ছিন্ন জীবনের সবচেয়ে ইতিবাচক হলো আমার পরিবারের সাথে কাটানোর জন্য অগাধ সময়। রান্নাঘরে আমার মাকে সাহায্য করার সময় মনে হয়েছে যেন নতুনভাবে আমার মাকে চিনছি। পড়াশোনার বকুনি দেওয়ার বাইরেও মায়ের সাথে যে আলাদা একটা সত্তা আছে তা এবার আবিষ্কার করলাম। সুস্বাদু খাবার রান্না শেখা শুরু করে জীবনে চলার পথে বাধা পেরিয়ে যাওয়া অনুপ্রেরণা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকেই। তবে বাবা সবসময় যেন এক অজানা চিন্তায় ডুবে আছেন। শুরুতে কিছুদিন বাড়িতে থাকলেও জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হতে হয়েছে তাকে। তবুও দিনশেষে আমি পেয়েছি আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়টি। আর তা হলো আমি যখন আমার মনোমুগ্ধকর পরিবারের সদস্যদের সাথে এক কাপ চা নিয়ে বসে গল্প করি।
আমি মনে করি আপনজনকে চেনার অপুর্ব সুযোগ হলো এই কোয়ারেন্টাইন। এই সাময়িক বিচ্ছিন্নতায় চিনতে পারা যায় কে প্রকৃত বন্ধু এবং আপনজন। নিয়মকানুন মেনে কে যোগাযোগ রাখছে, মুঠোফোনের মাধ্যমে হলেও কে নির্জনতাকে আনন্দময় করে তুলেছে। নির্জনতার সান্নিধ্য অর্জনের এক সুবর্ণ সুযোগ এই কোয়ারেন্টাইন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন(বাতায়নিকের পত্র-২)ঃ
‘স্থানের ফাঁকা না পেলে যেমন ভালো করে বাঁচা যায় না, তেমনি সময়ের ফাঁকা না পেলে মন বড় করে ভাবতে পারে না; সত্য তার কাছে ছোট হয়ে যায়। সেই ছোট-সত্য মিট্মিটে আলোর মতো ভয়কে প্রশ্রয় দেয়, দৃষ্টিকে প্রতারণা করে এবং মানুষের ব্যবহারের ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করে রাখে’।
তবে বলতে গেলে মানুষ কখনোই একা নয়। মানুষ মূলত দুটি জীবনযাপন করে। একটি দৈহিক ও একটি মানসিক। প্রতিটি মানুষের মধ্যে আরেকটি মানুষ থাকে যাকে আমরা ‘আমি’ বা মন বলি। আমরা জনবিচ্ছিন্ন হলেও পাহাড়, পর্বত, গভীর অরণ্য এমনকি সাগরতলে গেলেও আমার ‘আমি’ আমার সঙ্গে থাকে। শুধু আমার ‘আমি’ কে আবিষ্কার করে তার সঙ্গে গড়ে তোলাই ব্যাপার।
তাই এই নির্জনতার দিনগুলোতে আমি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছি। কিছু গল্প ও কাহিনী লিখতে শুরু করেছি যা আমার অনড়তা দূর করতে সহায়তা করেছে এবং আমার জ্ঞানের বাতায়নকে করেছে উন্মুক্ত।
আমি আমার অফুরন্ত সময়কে বাগানের কাজেও লাগিয়েছি যা আমার প্রজ্ঞা, ধীশক্তি এবং বিচক্ষণতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
আবার, নির্দিষ্ট চাকরী বা পেশার বাইরেও প্রতিটি মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কোন না কোন সৃজনশীলতা। সেটাকে জাগিয়ে তোলার এমন সুযোগ আর হয় না।
কবিগুরুর ভাষায়ঃ
যে পারে সে আপনি পারে,
পারে সে ফুল ফোটাতে।
সে শুধু চায় নয়ন মেলে,
দুটি চোখের কিরণ ফেলে।
অমনি যেন পূর্ণপ্রাণের
মন্ত্র লাগে বোঁটাতে।
যে পারে সে আপনি পারে,
পারে সে ফুল ফোটাতে।
তাই আমি নিজেকে ফটোগ্রাফির সাথে জড়িত করেছি এবং ইংরেজি শিক্ষায় আমার দক্ষতা সঞ্চারিত করেছি। এছাড়াও অনেকগুলি অনলাইন ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। সবমিলিয়ে আমি আমার সময়কে যথার্থভাবে কাজে লাগিয়ে নিজে ভালো থাকার ও আমার আশেপাশের মানুষদের ভালো রাখার চেষ্টা করেছি।
এ কথা সত্য যে সবাই তাদের নিজস্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করবে। তবে আমি মনে করি এই দুঃসময়ে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখাটাই বিচক্ষণতার পরিচয়। আমরা কেউ ই জানি না এই মহামারী কবে শেষ হবে অথবা মহামারী পরবর্তী সময়ে আমাদের পরিস্থিতি কীরুপ হবে। সুতরাং আমার বিবেচনা এই যে সবাইকে প্রস্তুত হওয়া উচিত যেন আমরা করোনা মহামারীর ক্ষতি পুষিয়ে সাফল্য ও উন্নয়নের হাল ধরতে পারি।
Sumaiya Khanam
University Category
GB068