স্তন ক্যান্সার ও মানসিক স্বাস্থ্য
প্রথাগতভাবেই বাংলাদেশে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা নিয়ে জনসমাগমের মাঝে এমনকি পরিবারের সদস্যদের মাঝে কথা বলাও অস্বস্তি কিংবা বিব্রত বোধ করার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন, ঋতুস্রাব কিংবা ডিপ্রেশন-হতাশার সময় কারো কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানানো ইত্যাদি। মানুষ সাধারণত এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিংবা কাউন্সেলিংয়ের দ্বারস্থ হওয়ার ব্যপারেও নিমরাজি হয় কিংবা লজ্জাবোধে ভোগে। আজ আমরা আলোচনা করবো, বর্তমান বাংলাদেশের এমনই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা তথা স্তন ক্যান্সার ও কীভাবে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে- তা নিয়ে।
‘স্তন ক্যান্সার’- শব্দবন্ধনীটি শুনলেই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাঝে একটি লজ্জা, অস্বস্তি কীংবা লুকোছাপার ভাব জন্ম নেয়, অনেকে বিব্রতও বোধ করেন। তবে, অদৃশ্য, ‘অলঙ্ঘনীয়’ এই লুকোচুরির পর্দা সরিয়ে নারী-পুরুষ সকলেরই স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে বর্তমান সময়ে সাধারণ ধারণা রাখা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্তন ক্যান্সার কী ধরনের প্রভাব ফেলে- এর প্রতিকার বা প্রতিরোধ কীভাবে করা যেতে পারে সে বিষয়েও ধারণা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে, বিশেষ করে মফস্বল কিংবা গ্রামাঞ্চলে এবং শহরের ধর্মীয়ভাবে অতি রক্ষণশীল পরিবারগুলো সাধারণত এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলা পছন্দ করে না, কখনো কখনো ধর্মীয় দিক থেকে এ বিষয়ে যথাযথ কাউন্সিলর বা ডাক্তারের সাহায্য নেয়াকেও অনৈতিক বিবেচনা করে, যা একটি ভ্রান্ত ধারণা। স্তন ক্যান্সার ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর নেচিবাচক প্প্রভাব শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তিকেই প্রভাবিত করে তা নয়, বরং আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার, সমাজকেও নানাবিধভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তবে দুঃখজনকভাবে বর্তমানে আমাদের সমাজ বাস্তবতা এরূপ যে উচ্চশিক্ষিত অনেক পরিবারেও এ বিষয়টি অনেকটি ট্যাবুর মতো, সুতরাং স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে জানাশোনার পরিমাণ যে আরো উল্লেখযোগ্য পরিমানে কম, তা বলাই বাহুল্য।
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র আছে বলে বিভিন্ন গবেষণা নির্দেশ করে। বাংলাদেশে, অধিকাংশ সময়েই এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচিত হয় না। ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুযায়ী, স্তন ক্যান্সার হতে আরোগ্য লাভ করা ব্যক্তিদের মাঝে ৯.৪-৬৬.১ শতাংশ ডিপ্রেশনে এবং ১৭.৯-৩৩.৩ শতাংশের মাঝে দুশ্চিন্তা পরিলক্ষিত হয়। তবে, বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও, হাতেগোনা কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ব্যতীত এই খাতের সামগ্রিক চিত্র এখনো খুব একটি আশাব্যঞ্জক নয়।
‘দ্য জার্নাল অব ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট’ এ সাম্প্রতিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে স্তন ক্যান্সার থেকে সুস্থতা লাভ করেছেন এমন নারীদের পরবর্তীতে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতার মুখোমুখি হবার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত নারী কখনো কোনোরূপ ক্যান্সারের সম্মুখীন হন নি, তাদের তুলনায় স্তন ক্যান্সারকে জয় করেছেন- এমন নারীদের দুশ্চিন্তা ও মানসিক অবসাদে ভোগার প্রবণতা এবং সেক্সুয়াল ডিসফাংশানের আশঙ্কা অন্তত দু’গুণ বেশি।
‘ব্রেস্ট ক্যান্সার অর্গানাইজেশনে’ প্রকাশিত এক রিপোর্টানুযায়ী, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দিতে পারে, তার মাঝে রয়েছে-
☞ ডিপ্রেশন
☞ দুশ্চিন্তা
☞ ক্লান্তি ও অবসন্নতা
☞ ইনসমনিয়া
☞ দুর্বল স্মৃতিশক্তি বা স্মৃতিলোপ
☞ পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিজঅর্ডার( পিটিএসডি) ইত্যাদি।
স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হলে ঘাবড়ে না গিয়ে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার লক্ষ্যে কাজ করা অনেকাংশেই আক্রান্ত রোগীর জীবনযাপনের মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা গেলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান কীংবা কাউন্সেলিংয়ের শরণাপন্ন হতে হবে, যেমন-
✔ ঘুমে ব্যাঘাত (জেগে থাকতে কীংবা ঘুমোতে সমস্যা হওয়া)
✔ সামগ্রিকভাবে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন (সার্বক্ষণিক মানসিক চাপ অথবা দুশ্চিন্তা অনুভব করা)
✔ ক্ষুধায় পরিবর্তন, ফলশ্রুতিতে ওজন বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া
✔ বিছানা থেকে উঠতে অনীহা কিংবা শক্তির অভাববোধ হওয়া (স্তনক্যান্সার নিরাময়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়)
✔ মনোযোগ ধরে রাখতে প্রতিকূলতা অনুভব
✔ মানসিক চাপ কমাতে অ্যালকোহল বা নেশাদ্রব্য গ্রহণ
✔ মাথা ও পেটব্যথাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যাথার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া
যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ও এটি থেকে আরোগ্য লাভকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ধারাবাহিক উন্নতি সাধনে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন,
সুনির্দিষ্ট ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত, গবেষণালব্ধ ফলাফল যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা ও এটি সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, জাতীয় বাজেটে উক্ত বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো ও কু-প্রথা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
তৃতীয়ত, একটি একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করা গেলে রিসার্চ, মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
চতুর্থত, অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে, যেমন বাংলাদেশে, কীভাবে এটি সহজলভ্য করা যায় এবং আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী করে তোলা যায়- এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণও সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
সবশেষে, স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা ও ক্যান্সার পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যায় দক্ষ চিকিৎসক, নার্স, মনোবিজ্ঞানী তৈরীতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গড়ে তুলতে হবে এবং এর নিরাময়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে ক্যান্সারে ভোগা- ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর থেকে অন্তত ৫ বছর কিংবা তার বেশি সময়- ব্যক্তিদের মাঝে মানসিক অবস্থা সংক্রান্ত জটিলতা শনাক্ত হবার হার সাধারণ ব্যক্তিদের মাঝে সমস্যা শনাক্ত হবার প্রায় কাছাকাছি। অপরদিকে, স্তন ক্যান্সার শনাক্তের প্রথম বছর পার হবার পর মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতার মুখোমুখি হবার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই, স্তন ক্যান্সারকে জয় করে দিরে আসা ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে মানসিক অবস্থার উন্নতির ব্যপারে আশাবাদী হতেই পারেন, পর্যাপ্ত এবং সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এই লক্ষ্য অর্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে আপনি যদি মনে করেন আপনি এই সমস্যাগুলোয় ভুগছেন আপনি যত দ্রুত সম্ভব চেষ্টা করুন আপনার যে কাছের মানুষগুলো রয়েছে তাদের আপনার অনুভূতি ও সমস্যাগুলো জানানোর অথবা অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কাউন্সিলরের পরামর্শ নেবার। যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ একদিকে যেমন আপনাকে শারীরিকভাবে সুস্থ করে তুলতে পারে পাশাপাশি আপনার রোগ-পূর্ব, রোগ-চলাকালীন ও রোগ পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায়ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে ভূমিকা রাখে।
এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সহায়তায় আমাদের উচিত এই মানুষগুলো যেন আমাদের কাছে নিঃসংকোচে সমস্যা অথবা অস্বস্তির কথাগুলো খুলে বলতে পারে সে জায়গাটুকু তাদের জন্য নিশ্চিত করা চেষ্টা করা। পাশাপাশি, আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহস ও পরামর্শ দেয়া। সুপরামর্শ দিতে যদি অপারগ হন তবে যথাযথ ডাক্তার বা কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহায়তা করা। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে আমাদের সকলকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
#Grace
#Research & Publication
#Mental Health
#Health
#Self care
#Awareness
প্রদায়ক
সাদমান মুজতবা রাফিদ,
অ্যাসোসিয়েট পাবলিকেশন কো-অর্ডিনেটর, হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স, বাংলাদেশ।